উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না থাকার সিদ্ধান্তে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যেমন খুশি। দলের এই সিদ্ধান্তের কারণে ভোটের মাঠে কর্মীদের কদর বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে সর্বাত্মক ভোটে বিজয়ী করার প্রস্তুতিও নিয়ে মাঠে কাজ করছেন কর্মী-সমর্থকরা। শুধু তাই নয়, দলীয় মনোনয়ন না থাকায় ফুরফুরে মেজাজে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীরাও। নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা অংশগ্রহণমূলক করার শ্রুতিশ্রুতিও দিচ্ছেন কেউ কেউ। তবে দলীয় এই সিদ্ধান্তে ইতিমধ্যে ভোটের মাঠে কিছুটা তালগোল লেগেছে। একাধিক প্রার্থী থাকায় একে অপরের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, যা ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মতো ঘরোয়া বিভক্তি বাড়িয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন অনেকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজপথের প্রধান বিরোধীদলগুলো বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে না আসায় একদলীয় নির্বাচন হিসেবে দেখছেন। আর নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত বলেও মনে করছেন তারা। এ অবস্থা থেকে বের হবার পথ টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগকেই খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ১৩৯ উপজেলার ভোটে যে বিষয়টি আলোচনায় ছিলো তা হলো অন্য নির্বাচনের চেয়ে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির স্বল্পতা। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে খোদ সরকারি দলকেও। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো একতরফা নির্বাচন হওয়ায় ভোটার উপস্থিতি কম বলা হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা এখন আর নেই। তারা এও বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো না গেলে আগামীতে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে যাবে। আর এ দায় ক্ষমতাসীন দলকেই নিতে হবে। তারা বলছেন, দলগুলোর দিকে তাকিয়ে না থেকে কমিশনকেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
প্রার্থীর পক্ষে এমপি নজরুল, ভোট নিয়ে শঙ্কা : আড়াইহাজারে ২১ মে নির্বাচন। এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জেলা মহিলা লীগ নেত্রী শাহিদা মোশারফ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে এই দুই পদে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। তবে নির্বাচনের প্রচারণায় বিতর্কিত বক্তব্য, প্রতিপক্ষের সমর্থকদের হুমকির অভিযোগ এবং একজন প্রার্থীর পক্ষে সংসদ সদস্যের (এমপি) প্রকাশ্য সমর্থনের পর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ভোটের মাঠ বেশ উত্তপ্ত। এতে আড়াইহাজারের সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে। চেয়ারম্যান পদে উপজেলা পরিষদের দুবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শাহজালাল মিয়া, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি কাজী সুজন ইকবাল এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নির্বাচন করছেন। বিশনন্দী ফেরিঘাটে কথা হয় মৌসুমি ব্যবসায়ী আবদুল হালিমের সঙ্গে। এই ভোটার জানান, ভোটের দিন নির্বাচনের পরিবেশ কেমন থাকবে তার ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে কেন্দ্রে গেলে আড়াইহাজারকে ডাকাত, ভূমিদস্যু ও মাদকমুক্ত করতে পারবেন এমন প্রার্থীকেই তিনি ভোট দেবেন। তবে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু এরই মধ্যে সাইফুল ইসলামকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে তার পক্ষে প্রকাশ্যে নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন। সংসদ সদস্যের ঘোষণার পর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সাইফুলের পক্ষে পুরোদমে প্রচার চালাচ্ছেন। সাইফুল নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বিতর্কিত নাম। মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন নিয়ে সংঘর্ষ, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্য আলোচিত রুবেল মাহমুদ হত্যাকাণ্ডসহ কিছু হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে গত এক দশকে বারবার তিনি বিতর্কে জড়িয়েছেন।
সোনারগাঁও উত্তপ্ত নির্বাচনী মাঠ : নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভক্তি। হুমকি-ধামকিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে নির্বাচনী মাঠ। মূলত চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহফুজুর রহমান কালাম ও বাবুল ওমরের পক্ষে বিপক্ষে সমর্থন দেয়া নিয়ে এ বিভক্তি। এরই মধ্যে নির্বাচনী সমাবেশে চেয়ারম্যান প্রার্থী থেকে শুরু করে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে শুরু করেছেন। এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনসহ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় ভোটাররা সংঘাতের আশঙ্কায় করলেও নির্বাচনী আমেজে সরগরম পুরো উপজেলা। এ দিকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে প্রশাসন কাউকে ছাড় দিবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন উপজেলার যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু (মোটরসাইকেল), সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী হায়দার (দোয়াত কলম), উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালাম (ঘোড়া প্রতীক), উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বাবুল ওমর বাবু (আনারস প্রতীক)। এ ছাড়া পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চেয়ারম্যান পদে রফিকুল ইসলাম নান্নু ও মোহাম্মদ আলী হায়দার অনেকটা নীরবে নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে বাবুল ওমর বাবুকে সমর্থন দেন। তাই কাগজে কলমে নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তাদেরকে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে আর দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া স্থানীয় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা আনুষ্ঠানিক ভাবে বাবুল ওমরকে সমর্থন দিয়েছেন। এ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী না থাকলেও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সার স্থানীয় সকল জনপ্রতিনিধিদের বাবুল ওমরকে সমর্থন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে এ সংসদ সদস্যকে প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা দিতে দেখা যায়নি। এ দিকে, বারদী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বাবুল আনারস প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণায় সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সারের সমর্থন দেয়ার বিষয়টি বীরদর্পে প্রকাশ করেন। তবে সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সারের চাচা আওয়ামী লীগ নেতা মনির হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য মোবারক হোসেনের ছেলে এরফান হোসেন দ্বীপ, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের ছেলে তান্না মোশাররফ আনুষ্ঠানিকভাবে মাহফুজুর রহমান কালামকে সমর্থন দিয়েছেন। মাহফুজুর রহমান কালাম ও বাবুল ওমরের পক্ষে বিপক্ষে সমর্থন দেয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি গাজী মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহফুজুর রহমান কালামের নির্বাচনী প্রচারণায় বক্তব্যকালে বলেন, ভোটের বেপারি হয়েন না, ভোটের বেপারি হয়ে সুবিধা করতে পারবেন না। এই বক্তব্যে আব্দুল্লাহ আল কায়সারকে ইঙ্গিত করা হয়েছে দাবি করে এর প্রতিবাদে মানববন্ধন ও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম সাগর। আবার গাজী মুজিবুর রহমান সংবাদ সম্মেলন ডেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তার দাবি উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বক্তব্যে সংসদ সদস্যকে জড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, অবস্থা এমন যে, দল হয়ে গেছে প্রধান। আর জনগণ হয়ে গেছে শুধু তাদের সমর্থন দেয়া আর না দেয়ার বিষয়। কোনো দল যদি জনগণের কাছে না যায়, জনমুখী না হয় তাহলে রাজনৈতিক দল যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেভাবেই থাকবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, দেশের রাজনীতি পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি দলের মধ্যে বিভাজন দেখা যাচ্ছে। দলের পতাকা না হলেও কে কোন দলের, জনগণ জানে। মানুষের মধ্যে যেনো ভোটের বিষয়টি হারিয়ে যাচ্ছে, যে ভোট হলেই কী আর না হলেই কী। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনেই বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশ নিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন তো কারো জন্য বসে থাকবে না। তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন করা। কোন দল অংশ নিল আর কোন দল অংশ নিল না, এ নিয়ে তাদের কিছুই করার নেই। তবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর করা এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতেই দলীয় প্রতীক থেকে সরে এসেছিল আওয়ামী লীগ। এর ফলে উপজেলা পর্যায়ে সঠিক নেতৃত্ব উঠে আসছে এবং নির্বাচন উৎসবমুখর হচ্ছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, এবারের উপজেলা নির্বাচন চার ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোটের লড়াই শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ১৬০টি উপজেলায় ভোট হবে ২১ মে। আর তৃতীয় ধাপে ১১২টি উপজেলায় ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপে ৫৫টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে ৫ জুন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

# ভোটের মাঠে কদর বাড়ছে কর্মীদের # দলীয় মনোনয়ন না থাকায় ফুরফুরে মেজাজে প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা
- আপলোড সময় : ১৯-০৫-২০২৪ ০৮:৩০:০৮ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৯-০৫-২০২৪ ১১:৪৯:০৮ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ